ajkerit

শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগী হওয়ার বিশেষ কিছু কারণ সমূহ-

আগের দিনে ভোরবেলায় কুরআন তেলাওয়াত,মক্তবে আরবি পড়ার জন্য যাওয়া,বিকাল বেলায় খেলাধুলা,প্রাইভেট পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো শিশু কিশোররা। সন্ধ্যার পর প্রতিটা ঘরে শোনা যেতো পড়ার আওয়াজ।ছিলনা বৈদ্যুতিক বাতি, হারিকেন অথবা কূপি জ্বালিয়ে ও পড়া চলত পুরোদমে।

বিলাশ বহুল ঘর না থাকলেও যা ছিল সেখানেই পড়তে কোন সমস্যা হত না কারোরই।টিফিনের জন্য বাবার কাছ থেকে ৫-১০ টাকাই যথেষ্ট ছিলো।কালো ও নীল রংয়ের বলপেন,পেনসিল,'তা' দিয়ে সুন্দর করে খাতা বানানো,তার উপর বিভিন্ন ফুলের নকশা আকাঁ হত নিজের মনের মত করে।পড়ার উপকরণ ছিল বই,খাতা,৫টাকার কলম,সহায়ক হিসেবে গাইড ও গৃহ শিক্ষক। খেলাধুলা বা শৈশবের বাকি স্মৃতিগুলোর দিকে নাই বা গেলাম।


বর্তমানে ছেলে-মেয়েরা যেসব কাজে অভ্যস্থ–

ঘুম থেকে উঠে ৮-৯ টায়,এত বেলা ঘুমিয়ে ও তাদের ঘুম শেষ হয় না।কথা শুনলে মনে হয় স্বপ্নেই পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল নিয়ে এসেছে।মক্তবে গিয়ে পড়তে তাদের শত অনীহা,তাই বাবা-মা মক্তবে পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হন বাড়িতে হুজুর এনে পড়াতে, তবে শহরের চিত্র ভিন্ন।

স্কুলে গিয়ে তাদের পড়ার ধরণ দেখলে মনে হয় তারা শিক্ষক থেকেও বেশি জ্ঞানী।বিকাল বেলা দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধুলা আর হয় না,পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকলেও যতটুকু আছে তাতে ও তারা খেলতে নারাজ।ইন্টারনেটের যুগে বাসায় বসে ভিডিও গেইম খেলে সময় পার করছে তারা। এতে তাদের শারীরিক বৃদ্ধিতে যেমন ব্যাঘাত ঘটছে ঠিক তেমনি মানসিক চাপ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে।সন্ধ্যায় পড়তে না বসে অনেকেই বাজারে ঘুড়তে যায়,বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠে রাস্থার নির্জন স্থানটিতে।তারা মনে করে পড়ার সময় রাত ৯টার পর।


আমরা  অভিভাবকগনও অলসতা আর ব্যস্ততায় তাদের ইচ্ছেকেই সমর্থন করছি।  আমরা কখনোই তাদের অভ্যাস পরিবর্তন করার বা  বুঝানোর চেষ্টা করিনি।যদিও চেষ্ঠা করেছি, সেটা উপযুক্ত সময়ের পরে। তখন নিজেদের ব্যর্থতা আর অতিষ্ঠতায় পারলে হাত দিয়ে বা বেতের সাহায্যে দু'একটা দিয়ে শাসন করেছি, কিন্তু তাদের জেদের কাছে আবারো হেরে গিয়েছি।রাত করে পড়তে বসলেও কোন রকমভাবে এক ঘন্টা না পড়েই শেষ হয়ে যায় পড়া।ঘুমানোর আগে ফেইসবুকে একবার ঘুরে না আসলে তাদের চলেই না।একবার ভিডিও গেইম না খেললেতো সবই শেষ।

এখন আর হারিকেন নেই, কূপি নেই, আছে আইপিএস,চার্জ লাইট।


বিলাস বহুল ঘর আছে,নেই কোন প্রকার সমস্যা।বাবার কাছ থেকে টিফিনের জন্য ৫০ টাকার মত নেয়ার পরও মায়ের কাছ থেকে কিছু হলেও নিতে হয়।৫ টাকার কালো বলপেন আর চলে না,দামী সুন্দর ডিজাইনের জেল পেন লাগবেই,সাথে বিভিন্ন রংয়ের কলম তো থাকেই।রেডিমেইড খাতা কিনতে হয় এখন ফ্যাশন হিসেবে,'তা' দিয়ে বানানোর খাতা এখন সেকেলে মনে হয় তাদের।পড়ার উপকরণ বই,খাতা,কলম, গাইড এর পাশাপাশি আছে অনলাইন ক্লাস,ইউটিউব চ্যানেল,ভিডিও  ক্লাস,গুগল, জুমে ক্লাস।চার পাঁচ জায়গায় তো প্রাইভেট আছেই সাথে এত কিছুর সুযোগ সুবিধা থাকার পর ও ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এত অমনোযোগী কেন ? অভিভাবক হিসেবে আপনি/ আমি কখনও কি ভেবে দেখেছি?ভাবিনি-


আমরা নাম মাত্র চেষ্ঠা করে/ না করেই বলতে শুরু করেছি এই ছেলে-মেয়ে খারাপ,তার ছেলে-মেয়ে খারাপ।তারা কোন শিক্ষা পায় নি,তাদের অভিভাবক কিছু শেখায় নি এসব বলে একজন আরেক জনকে কাঁদা ছুঁড়তে ব্যস্ত।এটা মনে রাখতে হবে ছেলে-মেয়েরা নিজ থেকে পড়াশোনা যদি করতে না চায়, তাহলে তাদের পড়ানোর সাধ্য কারোরই নেই।


বাবা-মায়েদের কাছে বিশেষ  অনুরোধ -পারিবারিক কলহ থেকে ছেলে-মেয়েদের দূরে রাখুন।পারিবারিক কলহ তাদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে এতে তাদের পড়া শোনার মনোযোগ ব্যাহত হবে।


অভিভাবক হিসেবে করণীয়ঃ

         

১।সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলুন।সব ধর্মীয় শিক্ষায় আছে শান্তি,সমৃদ্ধির পথ এটা ছোটবেলা থেকে শিখাতে পারলে বড় হয়ে সে সেদিকেই হাঁটবে।

২।মানুষকে সাহায্য করতে শেখান ছোটবেলা থেকে।নিজে যা করবেন আপনার সন্তানও বড় হয়ে তাই করবে।

৩।সন্তানদের পড়াশোনার জন্য নিরিবিলি, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ দেয়ার চেষ্টা করুন।তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করানোর জন্য এটা আবশ্যক।

৪।সন্তানদের অমনোযোগী দেখলে তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন।যাতে তার কোন সমস্যা হলে সে নিজেই আপনাকে বলতে পারে।


এসব দিক খেয়াল রাখলে হয়তো ছেল-মেয়েরা পড়ার প্রতি অমনোযোগী না হয়ে আনন্দের সাথে পড়বে।


শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলছি- অযথা সময় নষ্ট না করে,বাবা মায়ের কষ্টের টাকা নষ্ট না করে একটু পরিশ্রম করলেই সফলতা আসবে।তোমাদের নিজের মনকে একটু স্থির করে চিন্তা করে দেখ তুমিই পারবে।তোমার দ্বারা যদি অন্য সব কাজ হয় তাহলে পড়াশোনা কেন হবে না? পড়াশোনায় নিজেকে মনোযোগী করার জন্য নিচের কাজ গুলো করতে পারো-


১।পরীক্ষা পাশ করার জন্য নয়,শেখার আনন্দে পড়তে হবে।

২।যেকোন একটা লক্ষ্য ঠিক করতে হবে,কোন বই আজ পড়ব তা না ভেবে কোন অধ্যায়ের কতটুকু আজকে পড়তে পারব তা নির্ধারণ করতে পার। পড়া বেশি মনে হলে পড়ার ভয়ে বাকিটুকু পড়া ও হবে না।

৩।নিজেকে পুরষ্কৃত করতে পারো অথবা বাবা-মা ছেলে- মেয়েদের উৎসাহ প্রদানের জন্য পুরষ্কৃত করতে পারেন।

৪।মনোযোগ বিঘ্নিত হয় এমন জিনিস গুলো দূরে সরিয়ে রাখতে পার।যেমনঃমোবাইল ফোন,খেলার সামগ্রী,টিভি বন্ধ রাখতে পার।

৫।এক নাগাড়ে না পড়ে ছোট ছোট বিরতি নিতে পার এতে মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে তোমাদের।

৬।নিজে যা শিখতে পেরেছি তা অন্যকে শেখাতে চেষ্টা কর।এতে নিজের শেখার বিষয়ের প্রতি আত্নবিশ্বাস বাড়বে,মনেও থাকবে বেশি।

৭।সব কিছুর আগে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে।সুস্থ না থাকলে পড়াশোনা কেন কিছুই করতে ভালো লাগে না।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর মনোযোগ বাড়াতে শিক্ষকের করণীয়

অনেক সময় ক্লাসরুমে এমন শিক্ষার্থী দেখা যায় যাদের পড়ালেখার এবং ক্লাসরুম পারফরমেন্সের ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকে না। ক্লাসে প্রবেশ করার সাথে সাথেই এরকম শিক্ষার্থীদের চেনা যায়। শিক্ষকই পারেন তার ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিতে। কারণ, দিনের একটি বড় অংশ তারা শিক্ষকের সাথে বিদ্যালয়ে কাটায়। উৎসাহ হারিয়ে ফেলা শিক্ষার্থীদের উৎসাহ ফিরিয়ে আনার জন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা মনে করি তা পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।

১) শিক্ষার্থীদের সুনাম করুন এবং তাদের সম্পর্কে ভালো ভাল কথা বলুন। ক্লাসে যে কাজ দেয়া হোক, তাদের ভুল শুধরে তাদের কাজের গুরুত্ব দিন। তাদের নোটবুক বা ডায়েরিতে পজিটিভ ফিডব্যাক লিখুন।

২) সময় বেঁধে কাজ শেষ করার জন্যে শ্রেণির কাজে চ্যালেঞ্জ দিন, এতে তারা আগে কাজ শেষ করার জন্যে হলেও আগ্রহী হয়ে উঠবে।

৩) যে টপিকই পড়ান না কেন প্রাসংগিক অজানা গল্প বা উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করুন।

৪) শ্রেণীকক্ষ সম্পর্কিত কিছু কাজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দিন। যেমন- ক্যালেন্ডার, দেয়াল পত্রিকা, অ্যাটেন্ডেন্স নেয়া, বোর্ড পরিষ্কার করা, চেয়ার-টেবিল ঠিক রাখা ইত্যাদি।

৫) ছাত্রছাত্রীদের হাতে শ্রেণির পাঠের কিছু দ্বায়িত্ব বা কন্ট্রোল দিয়ে দেয়া উচিত, এতে তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আগ্রহী উঠে উঠার সম্ভাবনা অনেক।

৬) পারফরমেন্সের ওপর পড়ার চাপ কমিয়ে দিতে পারেন মাঝেমাঝে। যেমন- একজন ছাত্র পুরো সপ্তাহ ক্লাসে উপস্থিত থাকলো। তার পুরস্কার স্বরুপ পরের সপ্তাহে প্রথম দিনের ক্লাসে বাড়ির কাজ অফ করুন। এরকম ছোট ছোট পুরস্কার লার্নিং এ অনেক সহায়ক হতে পারে।

৭) ক্লাসে যে টপিক পড়াবেন বাড়ির কাজ কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের দৈনিক জীবনের উপর নির্ভর দেয়ার চেষ্টা করুন, এতে তাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পাবে।

৮) ক্লাসে মনোযোগী ও সবার সাথে ভালো ব্যবহারের জন্যে ক্লাসের বাইরে তাদের সাথে ভালো করে কথা বলা কার্যকর।

৯) ছোট বাজেটে ফিল্ড ট্রিপের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করুন। অনেক সময় বাজেটের স্বল্পতার কারণে ট্রিপের ব্যবস্থা করা যায় না। সেক্ষেত্রে ক্লাসের শুরুতে দল বেঁধে সারা স্কুল কম্পাউন্ড ঘুরিয়ে আনতে পারেন।

একজন অমনোযোগী ছাত্র একদিনেই শুধরে যাবে বা পড়ায় মন দিবে তা কিন্তু কখনওই ভাববেন না। এটা অনেক ধৈর্য্যের ব্যাপার। নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে অমনোযোগি শিক্ষার্থীরাও আপনার চেষ্টায় মনোযোগী হয়ে উঠবে।


উপরোক্ত বিষয় গুলো মেনে চললে হয় তো এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব বেশি কঠিন কাজ হবে না।শিক্ষার্থীদের কাছে পড়াশোনা হউক আনন্দের,, কষ্টের নয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
pipilikait
pipilikait
pipilikait
pipilikait